বয়স্ক পাঠকদের জন্য সাহিত্য - সৌম্য ঘোষ

 
story and article

নিয়মিত পাঠক হিসাবে সাহিত্য চর্চা করে অনুধাবন করি, কেবল পড়লেই হবে না, লেখক হিসাবে নিজেকে এগিয়ে নিতে হলে, ‘বয়স্ক পাঠকের সাহিত্য’ রচনা করতে হবে । পড়তে হবে দেশ-বিদেশের সেই সব প্রবীণ লেখকের বই-পত্র যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে কীর্তিমান।

বুদ্ধিদীপ্ত পাঠকগণ, আশা করি, বুঝতে পেরেছেন; ‘বয়স্ক পাঠক’ বলতে আমি এখানে নিছক বয়সের ভারে ক্লান্ত ব্যক্তিদের বোঝাচ্ছি না, বরং বলছি তাদের কথা যারা অল্প বয়স থেকেই মানসম্পন্ন বইপুস্তক পড়ে রুচিকে উন্নত করেছেন এবং যাদের আছে গ্রন্থের ভালো-মন্দ বিচারের সহজাত প্রতিভা।

সেই শ্রদ্ধেয়জনদের রুচির উপযুক্ত সাহিত্য লেখার জন্য বড় রকম প্রস্তুতি প্রয়োজন।

রুচি অর্জন করতে না পারলে সুলিখিত সাহিত্যগ্রন্থও রচনা করা সম্ভব হয় না। সাহিত্যিকের সাধনা, অতএব, সুরুচি অর্জনের সাধনা।

পাঠকেরও কিছু চেষ্টা থাকা দরকার। দরকার খোঁজখবর রাখারও। গত একশ বছরের শিল্প-সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি বিষয়ে যদি মোটামুটি ধারণাও থাকে তাহলে আশা করা যায় সেই পাঠক নতুন ধাঁচের সাহিত্যকে কম-বেশি সমর্থন করবেন। তা নাহলে হবে কি, তিনি হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পছন্দ করেন, কিন্তু জীবনানন্দ দাশ বা বিনয় মজুমদারের কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। “রামের সুমতি ” তার ভালো লাগবে অথচ ” তিতাস একটি নদীর নাম ” মনে হবে পাগলের প্রলাপ।

জীবনের অন্য অনেক ক্ষেত্রে উন্নত রুচির স্বাক্ষর রেখেছেন এমন মনুষও আধুনিক কবিতা বা উপন্যাস না-ও পড়তে পারেন যদি তার সাহিত্য পাঠেরই অভ্যাস না থাকে। রুচির ব্যাপারটাও তাই বিচিত্র ও ভাবনা উদ্দীপক।

আমি খেয়াল করে দেখেছি, অসংখ্য লেখকের পঁচিশ বছরের লেখার আর পঞ্চাশ বছরের লেখার মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। আমার প্রজন্মেরও অনেকের মধ্যেই এমনটা দেখা গেছে। এদের আমার সুইফটবর্ণিত লিলিপুটের মতো মনে হয় যারা ছ’ইঞ্চির বেশি কিছুতেই বাড়ে না। এ লেখকরা অর্বাচীন আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন এবং আত্মতুষ্টির অদ্ভুত এক ঘেরাটোপে নিজেদের বয়স বাড়ান।

অন্য দিকে, কম বয়সে রচিত লেখাকে কিংবা প্রাপ্ত বয়সেরও অনেক রচনাকে যারা মূল্যহীন জ্ঞান করেন এবং নিজের লেখাকে পরিবর্তিত ও ঋদ্ধ করতে চান, কিছুটা হয়তো করতে পারেনও তারাই উত্তরকালের শ্রদ্ধেয় বিবেচিত হন।

সৃজনশীলতা চিরকাল জঙ্গমতাকে লালন করে। অনেকেই ষাটোর্ধ্ব বয়সে লিখতে পারলেই খুশি হন। কিন্তু লেখালেখিতে সচলতাই মুখ্য নয়। বিষয়বস্তু, ভাষাব্যবহার, দৃষ্টিভঙ্গি, উপস্থাপনরীতি- অন্তত এর যে কোনো একটি ক্ষেত্রে সজীব সৃষ্টিশীলতার প্রয়োজন আছে

এবং এ সবকিছুর সঙ্গেই প্রাগুক্ত ‘রুচি ও প্রগতি’ বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান বা সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার জন্য পন্ডিত হবার প্রয়োজন পড়ে না ।

কিন্তু রিল্কের বা এলিয়টের কাব্য, কামুর কিংবা ওরহান পামুকের উপন্যাস, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা ভালো লাগার জন্য চর্চিত রুচির ও সাহিত্য-শিক্ষার প্রয়োজন দরকার ।

পাঠকের ক্ষেত্রে রুচির পরিপক্বতা যেমন উন্নতমানের গ্রন্থ অনুধাবনের বড় এক শর্ত, তেমনি লেখকের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। বিশেষভাবে প্রতিভাবান নবীন সাহিত্যকর্মীদের । আমাদের নমস্য প্রত্যেক কবি ও গদ্যকার তাদের জীবনের একটা বড় অধ্যায় অতিবাহিত করেছেন সজ্ঞান প্রস্তুতির ভেতর দিয়ে এবং সুনামের শক্ত ভিত তৈরি হয়ে যাওয়ার পরও তারা আত্মপ্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন; অসংখ্যবার আত্মসমালোচনা করেছেন নিজের নিভৃতে।

আজ চল্লিশ থেকে পঞ্চান্ন- বয়সের লেখকদের বিরাট অংশের লেখা পড়ে মনে হয় ,

কখনও কি নিজেকে এ প্রশ্ন করেছেন, কেন এসব লিখছি, কীভাবে এ অবস্থার আশান্বিত উত্তরণ সম্ভব? মূল সমস্যা হল মননের দারিদ্র্যতা। তাছাড়া কেউ যদি আত্মিক দুর্দশা সম্বন্ধে অজ্ঞ থেকে যান, তিনি কি করে নিজের অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাবেন?

বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরও জটিল এজন্য যে, এ ক্ষেত্রে শতকরা নব্বইজনই তদের ত্রুটি দেখতে পান না অথবা এত কম দেখতে পান যে সেই ‘দেখা’টা শেষ পর্যন্ত কোনো কাজে আসে না। এদের সিংহভাগই আবার নিজেদের ‘কাজ’কে সমৃদ্ধ স্তরের মনে করেন, যদিও আসলে তা নয়। এ জাতীয় অন্ধতা আর যা-ই হোক বয়স্ক পাঠকের উন্নত মনের খোরাক জোগাতে পারে না।

বয়স্ক পাঠকরা, আমরা জানি, সাধারণত জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে থাকেন। স্বভাবতই তারা সাহিত্যেও জীবনকে বস্তুনিষ্ঠভাবে চিত্রায়িত হতে দেখতে চান।

এমনকি কবিতার মতো ইঙ্গিতধর, রহস্যমধুর সাহিত্য মাধ্যমেও তারা জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ভালোবাসেন। আবার পাঠ্যবস্তুর সঙ্গে জীবনের নানামাত্রিক অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে তার গ্রন্থমূল্য উপলব্ধির আকাঙ্খাও কাজ করে পাঠকের মনে।

লেখকের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পাঠকের বাস্তবতাজ্ঞান ও কল্পনা যখন এক বিন্দুতে মেলে তখন পাঠক বিস্মিত হয়ে বলেন, আরে তাই তো! জীবন তো এমনই! কিন্তু এটা আমার মাথায় আসেনি।

সাহিত্যরুচি মেধা, সৃষ্টিপ্রতিভা ও বয়সের সম্মিলিত অবদান। যৌবনকালেই যারা অগ্রসর চিন্তা ও লিখন রীতির পরিচয় রাখতে পারেন, পরিণত বয়সে তারাই তাদের সাহিত্যভাবনা ও রচনা প্রযুক্তিকে সুদৃঢ় ভিতের ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হন।

পাঠরুচি নির্ভর করে পাঠকের অর্জিত বিদ্যা বুদ্ধি, সহজাত অনুসন্ধিৎসা ও যাচাই প্রবণতার ওপর। একজন মানুষ কেমন পরিবেশে বেড়ে ওঠেন, তার আশপাশের লোকজন কী ধরনের বই পড়েন বা তাদের কথাবার্তা, আলাপের ধরন কেমন; তার পাঠক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এ সবের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অতি জনপ্রিয় লেখকদের বইয়ের প্রতি এই যে হাজার হাজার মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েন তার কারণ কি?

তার প্রধান কারণ ওইসব মানুষের মনের বয়স না বাড়া। এ ধরনের মানুষ প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারেন না। তাদের মাথায় এটা আসেই না যে দু’চারজন লেখকের দ্বারা তারা আচ্ছন্ন তাদের বাইরেও লেখক আছেন এবং তাদের ভেতর অধিক শক্তিশালী লেখক থাকতেই পারেন। ফলে কী হয়?

জনপ্রিয় লেখকরা তাদের হালুইকর সুলভ পুনরাবৃত্তির ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকেন এবং ওই পাঠকরাও রসগোল্লা সদৃশ রচনা খেতে থাকেন বছরের পর বছর। স্মর্তব্য, জনপ্রিয় সাহিত্যের প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হয় প্রথমত জনশ্রুতি দ্বারা।

জনশ্রুতি সেসব পাঠককে সহজেই প্রভাবিত করতে পারে যাদের নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনা দ্বারা চালিত হওয়ার ক্ষমতা নেই। এরা সব অপরের মুখে ঝাল খাওয়া বিভ্রান্ত পাঠক।

সচেতন পাঠকবৃন্দ অবশ্য বয়সে বয়সে একটু একটু করে তাদের সুরুচি নির্মাণ করেন। এ নির্মাণ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে মানুষের শুধু পাঠকসত্তা নয় বিচিত্র ব্যক্তিচরিত্রও প্রতিফলিত হয়। পাঠক তার পছন্দ-অপছন্দ, ভালো লাগা-না লাগার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন। লেখকের বেলায় ব্যাপারটা অত সহজ ও সাবলীল নয়।

কেননা তাকে অনেক কিছু ভাবতে হয়। তাকে লিখতে বসার আগে রচনার ভাব ও ভাষাশৈলীতে সুরুচির পাঠকের বোধগম্যতা, গল্পের গ্রহণযোগ্যতা, নামকরণ এসব সাত-পাঁচ চিন্তা করতে হয়। বঙ্কিমচন্দ্র, কমলকুমার, সন্দীপন বা শহীদুল জহিরের মতো ব্যতিক্রমী প্রতিভারা এসব হয়তো কমই ভেবেছেন। কিন্তু যারা প্রধানত ভাষার প্রযুক্তিবিদ নন, সেই লেখকদের উদ্বেগটা বেশি।

বিশ্বায়ন ও কর্পোরেট বাণিজ্যের বর্তমান যুগে সাহিত্যকেও ষোলোআনা পণ্য বানিয়ে ফেলা হয়েছে। হ্যাঁ, একটা উপন্যাস বা গল্পের বইও পণ্য যেহেতু তা বিক্রয়যোগ্য।

কিন্তু লাক্স সাবান আর উপন্যাসের মধ্যকার পার্থক্য ভুলে গেলে চলবে না। এ বড় পরিতাপের কথা যে, লেখকদের অধিকাংশই আজ এই পার্থক্যের কথা মাথায় রাখেন না।

সাহিত্য যে কেবল চারপাশের পরিবেশ, মানব মনের আলো-ছায়া দেশবাস্তবতা বুঝবার ও বোঝাবার মাধ্যম নয়, তা উন্নত জাতের বিনোদনও বটে এটা তাদের মাথায় কেউ ঢুকিয়ে দিতে পারবে না, যদি নিজেরাই না বোঝেন।

সারা বছর দৈনিকের-মাসিকের পাতায় সাহিত্য নামধারী যেসব বস্তু ছাপা হয় সেগুলোর ক’টি প্রকৃত সাহিত্য?

এমনকি লিটল ম্যাগাজিন নামে যেসব কাগজ বেরোচ্ছে দু-চারটা ছাড়া সেগুলো আর পাঠযোগ্য নয় আজ। লেখকরা দ্রুত খ্যাতিপ্রত্যাশী। কীভাবে বয়স্ক পাঠকের সাহিত্য সৃষ্টি করা সম্ভব, কী উপায়ে সমৃদ্ধ করা যাবে লেখক-ইমেজ সেদিকে তাদের মনোযোগ দেওয়া জরুরি ।।

লিখেছেন :— #সৌম্য_ঘোষ
 

চুঁচুড়া ।

#storyandarticle